রাজনীতি
বিভীষিকার দিন ৬ প্রাণ ক্ষয়
১৭ জুলাই ২০২৪
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে সংঘর্ষ ও হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় দুজন, চট্টগ্রামে তিনজন ও রংপুরে একজন রয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের পর ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, হামলা ও পুলিশের লাঠিপেটায় আরও পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ রয়েছেন বেশ কয়েকজন। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যে এসব সহিংসতার ঘটনা ঘটে। গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ এবং দুপুরের পর থেকে শুরু হওয়া সহিংতার ফলে রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ অবরোধ এবং অগ্নিসংযোগ ও বিক্ষোভের মুখে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন।উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর ও রাজশাহীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল বিকেল পৌনে ৬টার দিকে তাদের মোতায়েন করা হয়। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান) এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আগামীকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় সব শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। স্থগিত হওয়া পরীক্ষার তারিখ পরে জানানো হবে। এদিকে পবিত্র আশুরার কারণে আজ বুধবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি থাকছে না। গতকাল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে এ ঘোষণা দেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হামলা চালানো হয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’গতকাল বেলা ৩টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। এ সময় কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গুলি করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে হাতবোমার বিস্ফোরণও ঘটানো হয়। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ হামলা চালিয়েছেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন। চট্টগ্রামে নিহত তিনজনের মধ্যে দুজনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন মো. ফারুক (৩২) ও মো. ওয়াসিম (২২)। ফারুক একটি আসবাবের দোকানের কর্মচারী এবং ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বলে জানা গেছে। এ ছাড়া আহত অন্তত ২০ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক নুজহাত ইমু জানান, নিহত দুজনের মধ্যে ফারুকের বুকে গুলির চিহ্ন রয়েছে। ওয়াসিমের মৃত্যুর কারণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নিহত অন্যজনের পিঠেও গুলির চিহ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। গতকাল বিকেলে রাজধানীর ঢাকা কলেজের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে এক যুবক নিহত হন। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নিহত ওই যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তার নাম-পরিচয় জানা যায়নি। পরে একই এলাকা থেকে আরেকজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে সায়েন্সল্যাব এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ২টার দিকে ওই মিছিলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এরপর থেকে ওই এলাকায় দুপক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এরই মধ্যে বিকেল সাড়ে ৫টার পর সেখানে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। রংপুরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। নিহত আবু সাঈদ (২২) ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলন সমন্বয় কমিটির সদস্য ছিলেন। গতকাল দুপুর ২টার দিকে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে পুলিশও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে আহত হন আবু সাঈদ। পরে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয় বলে জানান জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আশিকুল আরেফিন। পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাধে। এতে অনেকে আহত হন। তাদের মধ্যে অন্তত চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহতদের ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ছিল। এজন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে শহীদ মিনারের কাছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে সমবেত হন। এর আগে থেকেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওমর বিন আবদাল আজিজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা চানখাঁরপুল মোড়ে অবস্থা নেন। বিকেল ৪টার দিকে শহীদ মিনারের সামনের সড়ক দিয়ে গুলিস্তানের দিকে একটি যাত্রীবাহী মিনিবাস যাওয়ার সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বাসটি থামান। তারা বাসের ভেতরে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। যাত্রীদের কয়েকজনকে ছাত্রলীগের কর্মী বলে তাদের সন্দেহ হয়। এতে আন্দোলনকারী ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে বাসটি ভাঙচুর করেন এবং ওই সন্দেহভাজনদের বাস থেকে নামিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের ভেতর নিয়ে যান। এ ঘটনার পর কাউন্সিলর ওমর বিন আবদাল আজিজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের দলটি ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এরপর বিকেল সোয়া ৪টার দিকে উভয়পক্ষের মধ্যে মারধর ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শহীদুল্লাহ হলের সামনে এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা চানখাঁরপুলের সড়কের ওপর অবস্থান নিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। বিকেল ৫টার পরপর ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান থেকে কয়েকটি হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের পাশের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওই এলাকায় সন্ধ্যার পরও বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলতে থাকে। ঢাকা কলেজের ফটকের সামনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হাতে রামদা, রড, লোহার পাইপ, লাঠি নিয়ে অবস্থান নেন। খানিক দূরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও অবস্থান নেন। তখন থেকে দুপক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। বিকেল সাড়ে ৫টার পর শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার কিছুক্ষণ আগে ঢাকা কলেজের সামনে পিটুনিতে এক যুবক নিহত হন। ওই যুবককে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে তার নাম-পরিচয় জানা যায়নি। ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, নিহত যুবকের বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। তার পরনে জিন্সের প্যান্ট ও সাদা গেঞ্জি ছিল। তার মাথায় আঘাত রয়েছে। সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সংঘর্ষে আহত আরেক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তার মৃত্যু হয়। তিনি আহত অবস্থায় সিটি কলেজের সামনে রাস্তায় পড়ে ছিলেন বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। পথচারীরা ওই যুবককে উদ্ধার করে প্রথমে পাশের পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তার নাম মো. শাহজাহান (২৫) বলে জানা যায়। নিহত শাহজাহান নিউ মার্কেট এলাকার হকার ছিলেন। স্ত্রী ফাতেহা আক্তারকে নিয়ে থাকতেন কামরাঙ্গীচরের চান মসজিদ এলাকায়। তার বাবার নাম মৃত মহসিন। মা আয়েশা বেগম ও মামা মোসলেম রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢামেক মর্গে গিয়ে শাহজাহানের লাশ শনাক্ত করেন। তারা জানান, শাহজাহান নিউ মার্কেটের বলাকা সিনেমা হলের সামনে পাপোশ বিক্রি করতেন। সকালে কাজের জন্য বাসা থেকে বের হন। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে শাহজাহান ছিলেন তৃতীয়। ওই এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে এ দুজনের মৃত্যুসহ অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও শতাধিক শিক্ষার্থী। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন যে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অবস্থান থেকে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে পাঁচ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে আহত কয়েকজনকে গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তাদের মধ্যে তিনজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এর আগে বেলা ৩টার দিকে নগরের মুরাদপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্রধারীরা গুলি ছুড়লে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে আহত অন্তত ২০ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সংঘর্ষের পর চট্টগ্রামে তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির ব্যাটালিয়ন-৮ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী। শিক্ষার্থীরা জানান, বিকেল সাড়ে ৩টায় কর্মসূচি ছিল চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশনে। তবে এর আগে থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে ষোলশহর রেলস্টেশনে অবস্থান নেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে খণ্ড খণ্ড জমায়েতে শিক্ষার্থীরা ষোলশহরের দিকে আসতে থাকেন। আসার পথে মুরাদপুরে একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুরুতে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করলেও পরে গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণ শুরু হয়। কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পরে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এভাবে দীর্ঘসময় ধরে চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে নগরের ব্যস্ততম সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ মানুষ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। শিক্ষার্থীদের কয়েকটি অংশ অলিগলিতে ঢুকে পড়লে সেখান থেকেও খুঁজে বের করে হামলা করা হয়েছে। রংপুরে গতকাল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হন। আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, দুপুরে রংপুর শহর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সমবেত হন। দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ অবস্থান নেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা ছিলেন পার্ক মোড়ের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। দুপুর আড়াইটার দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩০ জনের মতো রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। অন্যরা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুপুর ২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের কর্মীরাও শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ও ফাঁকা রাবার বুলেট ছোড়ে। এভাবে ত্রিমুখী পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সদস্য নিহত আবু সাঈদের বন্ধু অঞ্জন রায় বলেন, ‘শরীরে একের পর রাবার বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ। তার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। এ সময় সংঘর্ষ চলছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি হয়।’ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হৃদয় রঞ্জন রায় বলেন, ‘মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তির আগেই তার (আবু সাঈদ) মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরের একাধিক স্থানে রাবার বুলেটের ক্ষত রয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। কিন্তু রাবার বুলেটের আঘাতে মারা গেছেন কি না, তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ছাড়া এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) চার ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে অন্তত পাঁচটি আবাসিক হলে ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ভাঙচুর চালিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে অন্তত ১৫টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদকের কক্ষ ভাঙচুরসহ তাদের কক্ষে অভিযান চালিয়ে পিস্তল, মদ ও রামদা উদ্ধার করেন আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পাস আন্দোলনকারীদের দখলে ছিল। ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। আন্দোলনরত বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া খেয়ে ক্যাম্পাস থেকে পালান রাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব। বেলা ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্স হলের সামনে থেকে মোটরসাইকেলে করে পালান তিনি। এ সময় তার সঙ্গে কয়েকজন সহযোগী ছিলেন। অন্যদিকে বিক্ষোভ চলাকালে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে ক্যাম্পাসে কোথাও দেখা যায়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাসছাড়া করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল থেকে জাবির নিয়ন্ত্রণ নেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এরপর সারা দিন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে ‘ছাত্রলীগ প্রবেশ নিষেধ’ লেখা পোস্টার লাগানো হয়েছে। গতকাল বিকেল ৬টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে এ পোস্টার লাগানো হয়। পোস্টারে লেখা ‘ছাত্রলীগ প্রবেশ নিষেধ, আদেশক্রমে ছাত্রসমাজ’। রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনব্যাপী মুখোমুখি অবস্থানে ছিল ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বগুড়ায় শিক্ষার্থীরা মুজিব মঞ্চ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আওয়ামী লীগ অফিস, আওয়ামী লীগ নেতার রনির অফিস, বিএনপি অফিস, অস্থায়ী পুলিশ ডিউটি, অস্থায়ী সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ঘর, চা স্টল, শরবতের দোকান ভাঙচুর করেছে। এ সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে থাকা পাঁচ-সাতটি মোটরসাইকেল আগুন ধরিয়ে দেয়। এসব ঘটনায় বগুড়ায় কর্মরত তিনজন সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) শিক্ষার্থীদের আটকাতে ছাত্রলীগের দেওয়া তালা ভেঙে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। কুবি থেকে আন্দোলনকারীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোটবাড়ী এলাকায় অবস্থান নেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা মহাসড়কে অবস্থান করেন। এ ছাড়া পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি করলে এক শিক্ষার্থীর বুকে তিনটি রাবার বুলেট লাগে। পরে শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেন। সিরাজগঞ্জে শহরের বিভিন্ন সড়ক সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে ৫ পুলিশসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। এতে সাংবাদিক, পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত ৩০ জন। ঠাকুরগাঁওয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ আর পুলিশের টিয়ার শেলে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ ও ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন শিক্ষার্থীরা। বিকেল সাড়ে ৪টায় জেলখানার মোড়ে তারা অবস্থান নিয়ে ঢাকার সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। পরে সন্ধ্যা ৭টায় অবরোধ প্রত্যাহার করলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এ সময় ছাত্রলীগ ও কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় পাঁচজন আহত হন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। দুই ঘণ্টা রেল চলাচল বন্ধ থাকার পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উভয় পাশে অন্তত ৬০ কিলোমিটার সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। গাজীপুরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। চান্দনা চৌরাস্তায় ছাত্রলীগের একটি মিছিল শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা একযোগে পাল্টা ধাওয়া দিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে যান। বরগুনায় শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন ১০ শিক্ষার্থী। চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিক্ষার্থীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়ক প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। খুলনায়ও শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। ঝিনাইদহে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় আন্দোলনকারী অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। ফেনী শহরে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কিশোরগঞ্জে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষে দুপক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে এবং কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে রবিবার মধ্যরাতে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পরে সোমবার দুপুর থেকে আবারও বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ। বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত থেমে থেমে চলা সংঘর্ষে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। রাত ১০টার পর আন্দোলনকারীরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং সারা দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে গতকাল তাদের সমর্থনে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। বরিশালে মহাসড়ক অবরোধ করেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে অচল হয়ে পড়ে বরিশাল নগরীসহ ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়ক। নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো এবং সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধিদের তথ্যে প্রতিবেদনটি তৈরি
59
-
মেট্রোরেলে হামলার সমন্বয় করেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয়...
১ মাস আগে
-
সবকিছুর জবাব নিয়ে ছাড়ব: ছাত্রলীগ সভাপতি
২ মাস আগে
-
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীদের অব...
২ মাস আগে
-
কোটাবিরোধী আন্দোলনরত ছাত্ররাই বীর মুক্তিসেনা : জিএ...
২ মাস আগে
-
কুড়িগ্রামের ৩ উপজেলায় চেয়ারম্যান হলেন যারা
৩ মাস আগে
-
ভূরুঙ্গামারী দুই সম্পাদকের মধ্যে লড়াইয়ের আভাস
৩ মাস আগে